সাম্প্রদায়িক ঘৃনা ও একটি অনিশ্চিত সম্পর্ক

avatar

মা চয়নকে নিয়ে যাবে মেয়ে দেখতে। এটা কোন ফুল টস না। এটা ছিল সাংঘাতিক গুগলী। কারণ মেয়ে চয়নের জন্য না, চয়নের বড় ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে নিয়ে যাচ্ছে। চয়নকে স্যাম্পল হিসেবে। বিষয়টা হচ্ছে পছন্দ করেন সাইজ নিয়ে সমস্যা হবে না, সাইজ দেওয়া যাবে।

মায়ের বয়স হয়েছে। কাজ কাম করার জন্য হলেও অন্তত বাসায় একটা লোক দরকার। বড় ভাইয়ারও বিয়ের বয়স সেই কবে পার করেছে। ৩০ পার করে ৩২ এ ছুঁই ছুঁই। আর কয়টা দিন গেলে তো ছাদের সব মাল উধাও হয়ে যাবে। তখন টাকে শরিষার তেল মাখা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। মা বিয়ের কথা বললেই ফুটবলারদের মত কেরী কাটে বার হয়ে যায়। ধরা দিতে চায় না। গচি মাছের মত পিছলায় যায়। বিয়ে নাকি ঝামেলা তার কাছে। আর বিয়ে করলেই নাকি পরাধীনতার জিঞ্জিরে লটকে যাবে। সে তার স্বাধীনতায় কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দিতে চায় না। চয়নের ভাইয়ার বিয়ের প্রস্তাব আসলেই বলে আপনাদের কি করার আছে করেন। আপনারা দেখলেই হবে। একে নিয়ে তো মহা সমস্যা। তাই এবার মা চয়নকেই নিয়ে যাচ্ছে স্যাম্পল হিসেবে।

বড় ভাইয়ার বিয়ে করা ইচ্ছা না থাকলেও চয়নেরও তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। যত দ্রুত ভাইয়া কে হালাল করা যায় ততোই ভাল। এইটাকে কেহ ষড়যন্ত্রের আক্ষা দিয়েন না। তাছাড়া মেয়ে দেখতে গেলে নাকি খাওয়া দাওয়াও জমপেস হয়। চয়ন আবার খাওয়া দাওয়া পেলে দুনিয়া ভূলে যায়।

চয়নরা যথা সময়ে মেয়ের বাসায় হাজির। মেয়ের বাবা মা চয়নদের আপায়নের ব্যবস্থা করেছে ভালোই। বিয়ে না হলেও খাওয়াটা তো হচ্ছে। বড় ঘোমটা দিয়ে মেয়ে কে সামনে হাজির করা হল। মেয়ে অপরূপ সুন্দরী। যে কেউ এক দেখাতেই পছন্দ করবে। এবার হয়তো ভাইয়া না করবে না।

অবশেষে ভাইয়ার সেই মেয়েটি চয়নের ভাবী। তারপর দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর হয়ে গেলে। কিন্তু মা আর চয়নের বিয়ের কথা বলে না। এই মূহুর্তে মা'কে স্বার্থবাদী মনে হচ্ছে চয়নের। হবেও বা না কেন বলেন। মা তার কাজের আর বাসার সঙ্গী পেয়ে গেছে দেখে চয়নের বিয়ের ব্যাপারে কোন কোথাই বলছে না। এখন চয়ন ভাবছে না নিজের বিয়ের দায়িত্বটা নিজেকেই নিতে হবে। এরই মধ্যে এক সুন্দরী বিহারী মেয়ে ধরা দেয়।

চয়নদের শহরের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বিহারিদের বসবাস। বাংলাদেশের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে সব থেকে বেশি বিহারী চয়দের শহরেই রয়েছে। শহরের অধিকাংশ ব্যবসায়ী বিহারী। তারা তাদের পেশাগত জীবনের প্রথম পছন্দে রাখে ব্যবস্যা। তবে তারা শহরকে ব্যানিজ্যিক শহরে রূপান্তর করেছে। সাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য উদাহরণ হচ্ছে এই শহর। এখানে বিহারী ও বাঙ্গালীদের মধ্যে রয়েছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। যেকোন সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সকলের সমান অংশগ্রহণ থাকে।

তবে শহরের দু একটা বাঙ্গালী পরিবারের সাথে বিহারিদের একধরনের স্নায়ু যুদ্ধ চলতে থাকে। এই পরিবার কয়টি মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্র অঞ্চলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় বলে নয় সেই ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই। শহরের গোড়াপত্তন করেছিল এই পরিবার গুলো। এই পরিবারের অনেকেই যুদ্ধের সময় শহীদ হোন। সেই সময় কিছু বিহারী বাঙ্গালীর উপর অমানুষিক নির্যাতন, লুটপাট করতো। আর সব চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে এই পরিবার গুলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিল পত্রে তাদের আত্ম ত্যাগের কথা উল্লেখ্য রয়েছে।

আবার অনেক বিহারী মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙ্গালীদের আশ্রয়ও দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী আর এই বিহারী রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু সজনদের কারো কারো লাশ গুলো এখনো তাদের চোখে ভাষে আবার কারো কারো সজনদের মৃত লাশের ও সন্ধ্যান এখনো পাওয়া যায় নিই। পিতা হারা, ভাই হারাদের বেদনা সহজে কি ভূলা যায়? তাই তারা চিহ্নিত রাজাকার পরিবারদের প্রতি একধরনের ঘৃনা বিদ্বেষ থাকলেও সব বিহারীদের প্রতি এমন ঘৃনা পোষন করে না। কিন্তু সেই রাজাকার পরিবার গুলো কৌশলে সব বিহারীদের কে এই পরিবার গুলোর বিপক্ষে দ্বার করিয়ে দেয়। তারা এমন ভাবে কৌশল করে বিহারিদের বুঝিয়েছে এই বাঙ্গালরা সব বিহারীদের ঘৃনা করে। অথচ বিষয়টি ছিল কিছু চিহ্নিত পরিবারকে ঘৃনা করে। আর এই রাজাকার পরিবার গুলো তাদের যুদ্ধের সময় লুটপাট করে অনেক অর্থ সম্পত্তি জমিয়েছে। তারা তাদের অর্থ দিয়ে বিহারীদের কে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে নিজেদের অবস্থান তাদের কাছে পোক্ত করে নেয়। আর বিহারীরা আগে পড়াশুনা করতো না। তারা ছোট থেকেই ব্যবস্যায় মনোযোগ দিত। টাকা পয়শা হিসেব করতে পারলেই তাদের জন্য যথেষ্ট। তাই নিরক্ষর বিহারীদের সহজে তারা তাদের মধ্যে একধরনের ঘৃনা সৃষ্টি করে দিয়েছে। রাজাকার পরিবার গুলো চায় এই বিদ্বেষটা আজীবন থাকুক। কারণ যতদিন থাকবে এই বিদ্বেষ ততোই তাদের জন্য ভালো।

চয়ন ছিল শহরের সেই প্রভাবশালী শহীদ পরিবারের সদস্য। তবে তার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অর্ধেক ছিল বিহারী। উঠাবসা ছিল সবার সাথে। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক কোন ছাপ লক্ষ করা যায় না। আর সেও চায় না এই ঘৃনা আরো দীর্ঘ হোক। এই ঘৃনার অবসান হওয়া উচিত। কিন্তু সে চাইলেই কি হবে? এই ঘৃনার বীজ অনেক গভীরে বপন করা আছে।

এরেই মধ্যে সে প্রেমে জড়িয়ে পরেছে একটি বিহারী মেয়ের সাথে। তবে বিহারী মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে সে বিহারী বাঙ্গালীদের পারিবারিক সম্পর্ক তৈরী করে দীর্ঘদিনের ঘৃনার অবসান করতে চাচ্ছে।

চয়ন কি পারবে এই ঘৃনার অবসান করতে নাকি জীবনের একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে?

images (8).jpeg

Source



0
0
0.000
0 comments