দুই দেবদূত || জীবনের গল্প

avatar

20200804_140941.jpg


আসুন আমাদের গাড়ির নিকট.. দেখুন আমাদের বই.. এই বই পড়লে জানতে পারবেন- কোন রানীর ১৭ বার বিয়ে হয়েছিল .. কোন প্রাণী জিব্বা দিয়ে শব্দ শুনতে পায়.. কোন গাছে কথা বলতে পারে। আরও জানতে পারবেন- কোন দেশে বিয়ের আগে ছেলেরা পাত্রীকে মাথায় নিয়ে দৌড়াতে হয়..

রতন বলে যায়। ব্যস্ততম রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সে মাইকিং করে বই বিক্রি করে। আর মানুষের ভিড় বাড়ে। অবশ্য বই বিক্রি তার মৌলিক উদ্দেশ্য নয়। ওই করে আর কয় টাকা আসে?

রতন যখন বই বিক্রির ক্যানভাস করে, আর মানুষের ভিড় বাড়ে, সেই ভিড়ের মধ্যে রতনের ছোট ভাই রাতুল মানুষের পকেট কাটতে থাকে।

রতন এমন সব চমকপ্রদ কথা বলে মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করে ফেলে যে, মানুষ সম্মোহিতের মতো তার কথা শুনতে থাকে। আর এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে রাতুল। কেউ টের পায় না।

অবশ্য একেবারে যে টের পায় না, এমনটি নয়। একবার ধরা খেয়েছিল। রতন কৌশলে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সবাই যখন তাকে মারধর করে, সবার সাথে যোগ দিয়ে রতনও তাকে মারতে থাকে।

মারতে মারতে একসময় বলে, এভাবে মারলে মইরা যাইবো গা, তারচেয়ে বরং পুলিশের কাছে দিয়া আসি।

কে যাবে পুলিশের কাছে পর্যন্ত? সবাই রতনকেই অনুরোধ করে রাতুলকে থানায় নিয়ে যেতে। রতন নিয়ে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পর আস্তে করে তারা বাসায় চলে আসলো।


আজকেও ভীড় বেড়েছে। মনে হচ্ছে অন্যদিনের তুলনায় মানুষ একটু বেশি আজ! যখন রাতুল চোখ টিপ দিয়ে সরে গেল, রতন বুঝতে পারল- কাজ শেষ। তারপর রতনও তার ক্যানভাসিং বন্ধ করে যা কিছু বই বিক্রি হলো সেগুলো টাকা কালেক্ট করে বাকি বইগুলি বাঁধতে শুরু করলো।

images (3).jpeg

বইয়ের গাট্টি মাথায় নিয়ে রতন বাসার দিকে আসছে। ব্যস্ততম সড়ক পার হয়ে যেই এসে গলিতে ঢুকলো, রাতুল এসে তার সাথে যোগ দিলো। দুজন হাঁটছে আর কথা বলছে।
-আজকে কেমন ধান্দা হৈছে?
-মনে হয় ভালাই, কয়েকটা মানিব্যাগ দেখলাম ঢাউস মোটা।

বাসায় এসে তারা মানিব্যাগ গুলো চেক করতে শুরু করল। না, মন্দ নয়। আজ গড়পড়তা দিনের তুলনায় একটু ভালই কামাই হয়েছে। লাস্ট মানিব্যাগটা খুলে তারা বেশ খুশি হয়ে গেল। মানিব্যাগে প্রায় দশ হাজার টাকা!

তারা সাধারনত টাকাগুলো নিয়ে মানিব্যাগ ফেলে দেয়। শেষ মানিব্যাগটা যখন ফেলে দিচ্ছিল, সেই সময় রাতুল বলল, কাগজ একটা দেহা যাইতেছে!

রতন বলল, আরে ফালাইয়া দে। চিঠি হইবো হয়তো।

রাতুল কি মনে করে যেন কাগজটা খুলে দেখল, একটা চিঠি! এ যুগে কেউ চিঠি লেখে?

রতন বলল, পইড়া দেখি..


চিঠিটা খুলে দেখল, কাঁচা হাতের লেখা। লিখেছে:

সোনা মানিক,
জানি না তুমি কেমন আছো? জেলে ঠিকমত খেতে দেয় কি? সেন্ট্রি কি খুব বেশি মারে? জেলখানায় অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসা ঠিকমতো পাওয়া তো? আমি মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবো না। আমার অসুখ বেড়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে, টিউমার হয়েছে পাকস্থলীতে। অপারেশন করাতে হবে। নয়তো মারা যাবো। তুমি কবে ছাড়া পাবে? আমার অপারেশনের জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। শীঘ্রই অপারেশন না করালে হয়তো টিউমার ফেটে যাবে। তুমি বের হলে সরাসরি গ্রামে চলে এসো। যদি বেঁচে থাকি, দেখা হবে।
ইতি
তোমার জন্ম দুঃখিনী মা

এক সপ্তাহ আগের চিঠি। পড়ে তারা স্তব্ধ হয়ে গেল! রতন কাঁদছে। তাদের দুই ভাইয়ের মনে পড়ে গেছে তাদের মায়ের কথা। একসময় বিনা চিকিৎসায় তাদের মা কাতরাতে কাতরাতে মারা গেছে। তারা দুই ভাই তখন অনেক ছোট।

দুইটি সন্তান পাশে বসে শুধু দেখেছিল সেদিন। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল। তারা এতটাই ছোট ছিল যে, কি করবে.. কিভাবে করবে.. কিছুই বুঝতে পারছিল না। বৃষ্টিতে শহরের রাস্তায় হাঁটু সমান পানি উঠে গিয়েছিল। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি।

রতন বলল, হয়তো সে মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকাটা রাখছিলো। জেলখানা থেকা ছাড়া পাইয়া এই টাকায় জোগাড় করতে পারছে। আর আমরা সেইটা চুরি করে নিয়া আসছি! এটা কি ঠিক হৈলো?

রাতুল বলল, আমাদের উচিত টাকাটা ফেরত দেয়া। রতনও তার কথার সাথে সায় দিল।

তারা মানিব্যাগটা ভালো করে খুঁজে দেখল। একটা ঠিকানা লেখা আছে। রংপুর শহরের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের ঠিকানা। দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিল- সেই গ্রামে তারা যাবে।


পরের দিন ভোরের ট্রেনে ধরে তারা রংপুর শহরে চলে গেল। খুঁজে খুঁজে সেই ঠিকানা অনুযায়ী তারা এসে দেখল, বাসা খালি। কেউ নেই! একটা পরিত্যক্ত প্রায় বাড়ি পড়ে আছে।

আশেপাশে মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, এখানে এক বৃদ্ধ মহিলা বাস করতেন। তার ছেলে পকেট মারতে গিয়ে ধরা খেয়ে জেলে গিয়েছে। বৃদ্ধা মহিলা অসুস্থ। অপারেশন প্রয়োজন। কিন্তু কোন সম্পত্তি নেই যে, বিক্রি করে অপারেশন করাবে। হঠাৎ তার খুব ব্যথা উঠেছিল। দুজন তাকে সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে দিয়ে এসেছে।

images (4).jpeg

রাতুল এবং রতন হাসপাতালে গিয়ে ওই বৃদ্ধ মহিলাকে খুঁজে বের করল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে তার অপারেশন ব্যবস্থা করলো। মহিলাকে বলল, আমরা আপনার ছেলের পরিচিত। সে বিশেষ কারণে আসতে পারে নি। তাই আমাদেরকে পাঠিয়েছে।

মহিলা খুশিতে দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরল। মনে হল যেন তার নিজের ছেলে! তিনি বারবার খালি একটা কথাই বললেন, আমার রাজীব পাঠায়েছে তোমাদেরকে!

তারা দুই ভাই দুজন দুজনের দিকে তাকালো। মহিলার ছেলের নামও 'র' দিয়ে! রতন.. রাতুল.. রাজিব.. কি অদ্ভুত মিল! তারা দুই ভাই সেই বৃদ্ধা মহিলার অপারেশনের ব্যবস্থা করল।

এক সপ্তাহ পর মহিলাটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। বৃদ্ধাকে তারা বাসায় নিয়ে আসল এবং বলল, শহরে গিয়ে রাজীবকে তারা উনার কথা বলবে। এই বলে তারা বিদায় নিল।


রাজিব অত্যন্ত ধীর পায়ে অবনত মস্তকে বাসায় এসেছে। সে এখনো জানে না, তার মা বেঁচে আছে কিনা। মায়ের চিঠি পেয়ে অঝোরে কেঁদেছিলো জেলখানায়। জেলখানার দেয়ালে তার কান্নার শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সবাই অবাক হয়েছিল, এত হাসিখুশি ছেলেটা কাঁদছে!

স্বাধীনতা দিবসে অল্পকিছু কয়েদিকে ভালো আচরণের জন্য বিশেষ বিবেচনায় মুক্তি দেয়া হয়। রাজিব ভালো ব্যবহারের কারণে বিশেষ বিবেচনায় মুক্তি পেয়ে পরের সপ্তাহে ছাড়া পেয়েছে।

সে তার ঢাকার বাড়ির টেলিভিশন-ফ্রিজ সেকেন্ড হ্যান্ড দোকানে বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা পেয়েছে। সেটা নিয়ে ছুটে চলছিল গ্রামের দিকে। মাঝে ফুটপাতে একটুখানি দাঁড়িয়েছিল ক্যানভাস শুনে। তখন তার পকেট কেটে দেয় কে যেন। সে অবাক হয়ে যায়, তার মত এক্সপার্ট পকেটমারের পকেট কেউ কাটতে পারে!

এক সপ্তাহে ঢাকা শহরে যত আত্মীয়-স্বজন আছে সবার দ্বারে দ্বারে দিয়েছে। সাহায্য করার মতো একজনকেও পায় নি। যত আত্মীয় স্বজন ছিল, জেলে যাওয়ার কারণে সবাই তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। খালি হাতে ফিরে এসেছে।

দরজায় নক করল রাজীব। বৃদ্ধা মহিলাটি ডেকে উঠল, কে? রাজীব কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এখনো মহিলাটি তাহলে বেঁচে আছে! সে বলল, মা‌‌ আমি।

মহিলাটি বলে উঠলো, বাবা রাজীব। তুমি না আরো এক সপ্তাহ পরে আসার কথা?

রাজীব অবাক হলো, মানে?

রাজিব তার মায়ের মুখে সব ঘটনা শুনল। দুজন ছেলে নাকি এসে তাকে সাহায্য করে গেছে। টাকা দিয়েছে। অপারেশন করিয়েছে। একটু আগে ছেলে দুটো চলে গিয়েছে এখান থেকে। আর যাওয়ার আগে একটা চিঠি দিয়ে গেছে।

রাজু চিঠিটা চিনতে পারলো। জেলখানায় এই চিঠি আঁকড়ে ধরে কত কেঁদেছিলো। রাজিব বারবার জিজ্ঞাসা করল, কোনো ঠিকানা দিয়ে গেছে? তার মা বলল, _না। তা তো দিয়ে যায় নি। কেন, কি হয়েছে?

-ছেলে দুইটা মানুষ না মা, ফেরেশতা। আল্লাহ পাঠাইছে।

images (5).jpeg

20200627_034755.jpg


আত্মকথনঃ

poster_1593196763985_rd7uzi0du0.gif

আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।



"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"


        জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি


0
0
0.000
2 comments