দিগম্বর রাজা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির রাজকবিবৃন্দ || গোপালের অর্থশাস্ত্র (পর্ব ০৪)
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র'র রাজদরবারে অন্যতম সভাসদ ছিলেন গোপাল ভাঁড়। প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের জন্যে দেশব্যাপী গোপালের সুখ্যাতি ছিল। তাঁর বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। গোপাল ভাঁড়ের হাসির আড়ালে থাকে গভীর জীবনবোধ, সমাজ সচেতনতা এবং গভীর জ্ঞানের ইঙ্গিত।
একবার রাজামশাই-এর ইচ্ছে হলো কিছু দান করবেন এবং সেটা করবেন নিজের হাতে। তাই তিনি রাজ্যের যত দরিদ্র মানুষ আছে, তাদেরকে নদীতীরে আসতে বললেন।
রাজামশাই নৌকার উপর থেকে জিনিসপত্র দিতে শুরু করলেন। কিন্তু মানুষ কোন সিরিয়াল মেনটেন না করে সাহায্য নেওয়ার জন্য সবাই ঝাপিয়ে পরল। ভিড়ের মধ্যে যে যা পারল, কেড়ে নিয়ে নিল।
রাজার পেয়াদারা এত ব্যাপক মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো। সবশেষে জনগণ রাজার গায়ের থেকে স্বর্ণের অলংকার এমনকি জামা পর্যন্ত খুলে নিয়ে নিল। রাজার দিগম্বর হয় লজ্জা নিবারণের জন্য নদীতে ঝাঁপ দিলেন।
রাজ পেয়াদারা সেখান থেকে মানুষ হটিয়ে দিল আর রাজাকে নদী থেকে তুলে কাপড় পরিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসলো।
এই ঘটনা সব দিকে ছড়িয়ে গেল। রাজা তো চিন্তায় পড়ে গেলেন, তার মান সম্মান বুঝি আর থাকলো না! তিনি গোপালের শরণাপন্ন হলেন।
গোপাল সাথে সাথে সমাধান দিয়ে দিল: রাজামশাই, এ তো খুব সহজ। আপনি রাজ কবিদেরকে নির্দেশ দিন, আপনার স্তুতিবাক্য বর্ণনা করে এমনভাবে কবিতা লিখতে যে- আপনি এত বড় দাতা, নিজের পরিধেয় বস্ত্রখানা পর্যন্ত দান করে দেন! গরিবের কষ্ট দেখলে আপনি পাগলপ্রায় হয়ে যান। এমন জনদরদি নিবেদিত রাজা ইতিহাসে একমাত্র আপনিই।
রাজার আইডিয়াটা খুব পছন্দ হলো। তিনি কবিদেরকে ডেকে নির্দেশ দিলেন কবিরা তার নির্দেশমতো প্রশংসাস্তুতি করে কবিতা লিখল। সেই কবিতা ছড়িয়ে দেয়া হলো সারা রাজ্যে। সবাই জানলো রাজামশাই পরনের কাপড় পর্যন্ত খুলে দান করে দেন। তার বদান্যতার কথা শুনে সবাই ধন্য, ধন্য করল।
ফলের রাজা দিগম্বর হওয়ার ঘটনার লজ্জা ঢাকা পড়ে গেল এবং সবার থেকে রাজা ব্যাপক প্রশংসা পেলেন।
রাজা খুশী হয়ে গোপালকে পুরস্কৃত করলেন।
যদিও এটি একটি কাল্পনিক ঘটনা, কিন্তু আমাদের সমাজে এরকম প্রায়ই হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা অহরহ দেখা যায়।
অর্থনীতিতে বৈদেশিক সাহায্য বলে একটা কথা আছে। যদিও শব্দটা সাহায্য, আসলে এটা এক ধরনের ঋণ। ধনী দেশগুলো যদিও বিভিন্ন সময় দাবি করে থাকে যে দরিদ্র অনুন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য তারা এই সাহায্য দিচ্ছে, আসল ঘটনা কিন্তু তা নয়। বরং এর পেছনে আন্তর্জাতিক কিছু রাজনীতি লুকায়িত থাকে। আর তা হলো: নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব।
যেমন- কোন একটা দেশ অন্য দেশকে নিজের অনুগত করা কিংবা সেই দেশের উপর কোন শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পরাশক্তিগুলো বৈদেশিক সাহায্য শব্দটিকে ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের কথাই ধরুন। বাংলাদেশকে যারা বৈদেশিক সাহায্য দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসছে- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি সংস্থা এবং রাষ্ট্র, তারা বিভিন্ন সময় কিছু শর্তারোপ করে। যেমন তেলের মূল্য, জ্বালানি মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার ইত্যাদি বিষয়ে তারা প্রভাব বিস্তার করে। তাদের থেকে বৈদেশিক সাহায্য সুবিধা পেতে হলে তাদের শর্তাবলী মেনে মানিটারি পলিসি এবং ফিস্ক্যাল পলিসি গ্রহণ করতে হয়।
বর্তমানে ইন্ডিয়া এবং চায়নার মধ্যে এক ধরনের নিরব যুদ্ধ চলছে, মাঝে মাঝে সহিংসতার ঘটনা যেমন সম্প্রতিকালে লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। এর প্রেক্ষাপট চায়না এবং ইন্ডিয়া উভয়ই চাচ্ছে আমাদেরকে করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এমনকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য শিডিউল বহির্ভূত একটি ভ্রমণে হঠাৎ করে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। এটা মূলত বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখার জন্য চীন ও ভারতের একটা প্রতিযোগিতা।
এছাড়া আমরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অন্য শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোকে বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং সহায়তা দিতে দেখি। এটা মূলত হয়ে থাকে তাদের তেল সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এবং অন্যান্য ভৌগলিক রাজনীতিতে কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
তারা যখন অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক পলিসিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তখন সেটা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দিগম্বর হওয়ার মত সকলের নিকট দৃষ্টিকটু ভাবে প্রকাশিত হয়। ফলে তারা এটাকে আড়াল করতে এই শব্দগুলো ব্যবহার করে।
অনেকটা গোপালের সেই রাজ কবিদের মতো তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে। যারা প্রচার করে- অমুক দেশ তমুক দেশের উন্নয়নের জন্য এত টাকা বৈদেশিক সাহায্য দিয়েছে। আসল উদ্দেশ্যটা এখানে আড়াল করে তাদের সুনাম বাড়ানোর জন্য প্রশংসা করা হয়।
গোপালীয় অর্থশাস্ত্রের এই পদ্ধতি সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়, প্রতিষ্ঠিত এবং বহুল ব্যবহৃত একটি টেকনিক।
অর্থনীতির বিষয়গুলো একটু নিরস। তার উপর আমাদের অনেকেরই অর্থনীতির বেসিক আইডিয়া নেই। ফলে অর্থনৈতিক বিষয়ক লেখা দেখলে আমরা এড়িয়ে যাই। সেজন্য আমি চেষ্টা করছি, অর্থনীতি বিষয়ক কিছু সরস আলোচনা করতে। গল্পের মাধ্যমে কোন কিছু বোঝালে সেটা দীর্ঘদিন মনে থাকে এবং সহজে আয়ত্ত করা যায়।
গোপাল ভাড়ের মজার মজার ঘটনাগুলো সমকালীন অর্থনীতির সাথে লিঙ্ক করে অর্থনীতির বেসিক কিছু আইডিয়া দেওয়াটাই আমার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গোপালের অর্থশাস্ত্র ধারাবাহিকটি শুরু করেছি। আজ তার আরেকটি পর্ব ছিল। আগের পর্বগুলি পড়তে পারেন নিচের লিংকে গিয়ে:
ঘুঁটা থিওরী এবং করোনা পরবর্তী দেশের অর্থনীতি
শেয়ার ব্যবসা এবং বেগুনের গুনাগুন
জিডিপি এবং গোপালের শ্বশুরবাড়ি ভ্রমন
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
Hi @tariqul.bibm, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @linco!
Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.
JOIN US ON