বিবাহ: কান্না হাসির সন্ধিক্ষণ।

avatar

বরের বাড়িতে খাসির মাংসের সাথে বরের নিজের জমিতে চাষকৃত নতুন লাল পাকরী আলু দিয়ে পুকুরে ব্রয়লার মুরগীর ফিড দিয়ে চাষ করা রুই মাছের ঝোল দিয়ে তৃপ্তিজনক ভুড়িভোজনের পরে কনে পক্ষের অতিথিবৃন্দ বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। পুকুর পাড়ে সারি সারি লিচু এবং আম গাছের ছায়াতলে সকলে বিশ্রাম নেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, বরপক্ষ থেকে পরিবেশনকৃত শেষ রসদটুকু অর্থাৎ পান-সুপারি সঙ্গে কিছুটা মচমচে ভাজা ধনিয়া মুখে গুজে পরম আনন্দে চিবুতে চিবুতে। সকলকেই একনজর দেখেই আমার মনে হচ্ছিল, এই মাত্র সবাই মাঠে হাল চাষ করে এসেছে, ক্লান্তির কারনে ক্ষুধামন্দা, কাজের সময় মুখের দন্তযুগলের কোনবিধ পরিশ্রম হয় নাই বিধায় তাদেরকে পান চিবানোর মতো গুরুদায়িত্ব সপে দিয়ে বাকি অঙ্গঁগুলোকে সতেজ করার তাগিদে বৃক্ষের ছায়ার নিচে সমর্পন করেছে।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.24_pm_2_.jpeg

আহার যদি তৃপ্তিদায়ক হয় তবে মূখে প্রশান্তির প্রতিফলন খুবই স্বাভাবিক বিষয় বটে। তবে কনে পক্ষের অতিথিদের মুখে কেন যানি এক অতৃপ্তিকর অনুভুতি আমাকে বড়ই ভাবিয়ে তুলল। কৌতুহলি মন ঠিকই সঠিক কারনটা খুজে বের করল। নতুন আলু দিয়ে মাছের ঝোলটাতে নাকি লবন একটু বেশি হয়েছে, মাংসগুলো ভালোছিলো, কিন্তু আর একটু সিদ্ধ হলে,কামড়াইতে দন্ত যুগলের কষ্ট একটু কম হতো। যত্তোসব সব বাজে প্যাচাল, আরে বাবা তোরা কোন ভাবেই বর পক্ষকে ১০০ তে ১০০ দিবি না, সেটাই হলো আসল কথা। আমরা জাতে বাঙ্গালী, কজ্বি ডুবিয়ে খাবার পর, আমাদের নরম পানিয় অথবা হাজমোলা খেতে হয় না হজমের জন্য, নিমন্ত্রনকারি এবং রাধুনীর বদনাম না করা পর্যন্ত আমাদের ভক্ষনকৃত খাবার হজম হয় না। বিষয়টা আবছা আবছা জানা ছিল গত মাসের তিন তারিখ, আমার খুবই প্রিয় বেবি দিদির বিয়ের বরপক্ষের নিমন্ত্রনে সংজ্ঞা এবং উদাহরন দুটোই পেয়েছিলাম।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.25_pm_1_.jpeg

আমাদের দেশে একটা প্রচলিত কৌতুক আছে, “বিয়া যে কত্ত মজা, খালি খাওন আর খাওন”, বাস্তবটা কিন্তু তার ব্যতিক্রম নয়। আমার কাছে ইসলামিক বিবাহ আইন পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়, এই বিবাহ আইনে প্রকৃত পক্ষেই “বিয়া যে কত্ত মজা” বিষয়টার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীন দুই আনন্দেই উপভোগ্য। অপরদিকে হিন্দু বিবাহ আইনের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন সঠিক না।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.24_pm_3_.jpeg

কে বলে দেশ হতে যৌতুক প্রথা প্রায় লাঘব হয়ে গেছে, আমিতো এখন অবধি কোন হিন্দু মেয়ের বিয়ে যৌতুক ছাড়া হয়েছে এমন নজিড় দেখতে পেলাম না। হিন্দুদের বিয়েতে আনন্দ শুধু বড় পক্ষের লোকেদের কাছেই, কনে পক্ষের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন যায় না। আনন্দের চেয়ে মানুষিক দুচিন্তা বহুগুনে প্রভাবিত করে মেয়ে পক্ষের পরিবারকে। সঠিক সময়ে বড় পক্ষের হাতে পনের টাকা বুঝিয়ে দেয়া, বর পক্ষের অতিথীদের সর্বাধিক আপ্যায়ন করা, কারন আপ্যায়নের সামান্যতম ত্রুটি কনের সাংসারিক জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.24_pm_4_.jpeg

আমি বাংলাদেশের সকল হিন্দু পরিবারকে দিয়ে উদাহরন দেয়ার চেষ্টা করছি না, আমি আমার এবং আমার পড়াপ্রতিবেশীদের দিয়েই বাস্তব কিছু উদাহরন দিচ্ছি আপনাদেরকে। আমাদের পড়ায় মাত্র আট ঘর হিন্দু পরিবার, প্রতিটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা তিন দশক আগে, গ্রামের সর্বচ্চো কোঠায় ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি পরিবারে আর্থিক অবস্থা সত্যিই খুবই শোচনীয়, এর একটাই কারন প্রতিটি পরিবারের বিবাহযোগ্য কন্যাদের উচ্চ পনে খুবই স্বচ্ছল পরিবারে বিবাহ করানো। নিজের মেয়ে, বোন, ভাতিজি কিংবা নাতনিদের সুখের কারনে প্রতিটি পরিবার তাদের সর্বচ্চো সহায় সম্বল নিমালে তুলতে দ্বিধাবোধ করেন নাই।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.24_pm.jpeg

মেনে নিলাম হিন্দু আইনে মেয়েরা তাদের পৈতৃক সম্পত্তির কোন অংশ পায় না, তাই তাদের বিবাহের সময় বর পক্ষকে তার ভাগের অংশটুকু দিতে হয়। যাকে আমরা যৌতুক বলি তাই না। কিন্তু আমার গনিত ঠিক অন্য জায়গায়, বিবাহ যোগ্য কন্যার পিতার বর্তমান সম্পত্তির পরিমান বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ৫ লক্ষ টাকা। তার সর্বমোট দুইটি সন্তান একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। বর্তমান বাজার মূল্যে স্বচ্ছল পরিবারের একজন সূপাত্রের মেয়েকে বিবাহ দিতে হলে, মেয়ের বাবার কমপক্ষে ১০ লক্ষ কাচা টাকা গুনে গুনে খরচ করতে হবে। তাহলে হিসাব তো মিলাতে পারলাম না ভাই, এ কেমন নীতি, এ কেমন আইন।


whatsapp_image_2021_04_02_at_6.55.25_pm.jpeg

আমার বেবি দিদির বিবাহের শুরু হতে আরম্ভ করে শেষ অবধি আমি ছিলাম, পনের অংকটা তেমন বেশি ছিল না, মাত্র তিন লক্ষ টাকা নগদ, ছেলের বাড়ির বিয়ে খরচ বাবদ মাত্র এক লক্ষ টাকা, মেয়ের বাড়ির বিবাহ অনুষ্ঠানের খরচতো আছেই। সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে ছিল আমার দিদি, তাই জেঠ্যা মশাই কোন দ্বিধাকরেন নাই তার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে মেয়েকে সুপাত্রের হাতে সমর্পন করতে।

হিন্দু পরিবারে আসলেই কি কোন সুপাত্র আছে, কেমন করে আমি তাদের সুপাত্র বলব, পড়ালেখা শেষ করেছি, সরকারি চাকুরী জন্য শ-খানেক দরখাস্ত করা শেষ, এখন অবধি চাকুরীতো দুরের কথা, চাকুরীর ”চ” অবধি জোটে নাই কপালে, ছেলের আমার সোনার টুকরা যোগ্যতার কোন প্রকার কমতি নাই, আজকাল ঘুষ ছাড়া কি, সরকারি চাকুরী পাওয়া যায় বলেন, তাই বিবাহ করে, যৌতুকের টাকা ঘুষ হিসাবে প্রদান করে ছেলেকে সরকারি চাকুরীজীবি করতে চাই। আমাদের দেশের ‍মুষ্ঠিমেয় বেকার হিন্দু ছেলেদের পিতা মাতার অভিব্যক্তি এটি।


img_20210303_171900.jpg

কিভাবে আমারা তাদেরকে সুপাত্র বলতে পারি বলেন, যে সব পাত্রের পরিবার পনের সাথে, ছেলের বিবাহের অনুষ্ঠানের খরচের টাকাটা আলাাদা ভাবে পাত্রি পক্ষের কাছে দাবি করেন। নিজের বিবাহের অনুষ্ঠানের জন্য সামান্য কিছু অর্থের যোগান যে পাত্র দিতে পারে না, সে পাত্র কিভাবে যোগ্য পাত্র হয়, এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন অবধি কোথায় খুঁজে পাই নাই, আপনার জানা থাকলে আমাকে জানাবেন দয়া করে।

তাইতো কনের পক্ষের অতিথীরা বর পক্ষের বাড়িতে কজ্বি ডুবিয়ে খাবার পরেও বর পক্ষের নিন্দা করতে পিছু পা হয় না, এর একটাই কারন সম্মানটা যে মনের ভিতর থেকে আসতে চায়, শুধু বেড়িয়ে আসে বুক ভরা আক্ষেপ।

আমার গল্পের শিরোনাম কান্না হাসির সন্ধিক্ষন রাখার একটাই কারন যৌতুকের টাকায় বর পক্ষের লোকেদের যখন আন্দদের সীমা থাকে না, সেই যৌতুকের টাকা পরিশোধের দুচিন্তায় কনে পক্ষের লোকেদের আনন্দ কান্না রূপে বেড়িয়ে আসে।



0
0
0.000