আল মাহমুদের মিথ্যাবাদী রাখাল, কালের অন্যরকম উপাখ্যান

avatar

লোকজ গল্প নিয়ে অনেক কবিতা সাহিত্য রচিত হয়.. কখনো কখনো গল্প বা চরিত্রগুলো আমাদের জীবনের সাথে এমন ভাবে মিলে যায় যে.. আমরা অভিভূত হই! কখনো সেগুলো রূপক আকারে আসে.. আবার কখনো কখনো সরাসরি মিলে যায়।

কিন্তু কোন রুপকথা বা উপকথা যখন ভিন্নভাবে আমাদের জীবনের সাথে ধরা দেয়.. তখন আমরা অভিভূত হওয়ার চেয়ে বরং আশ্চর্য হই। রূপকথা কিংবা উপকথাগুলোর প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করা মহৎ সাহিত্যিকদের কাজ.. এটা খুব কঠিন.. এটা সবাই পারে না.. যারা পারে- তারা অবশ্যই কিছু বিশেষত্বের দাবি রাখে।

আমি বরাবরের মত আশ্চর্য হই কবি আল মাহমুদের এই গুনটি থেকে.. এত সাবলীলভাবে উপকথাগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে নতুন বিশ্বাস কিংবা নতুন ধারণা ভিত গড়তে পারেন তিনি.. যা শুধুমাত্র মহৎ সাহিত্যিকদের পক্ষে সম্ভব। আমরা গর্বিত যে.. আমাদের দেশের একজন কবি এই কাজটি সুনিপুণভাবে অসংখ্যবার করেছেন!

এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে সফল সৃষ্টিকর্ম মিথ্যাবাদী রাখাল... এতে কোন সন্দেহ নেই। মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা সবাই জানে.. ছেলেটা সব সময় বাঘ,বাঘ বলে চিত্কার করত... আর সবাই দৌড়ে এসে দেখত যে বাঘ নেই। তারা ছেলেটাকে গালমন্দ করত।
images 39.jpeg

তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসলো.. ছেলেটা তখন বাঘ, বাঘ বলে চিৎকার করলো.. কিন্তু সেদিন কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না.. সবাই ভাবলো- অন্যান্য দিনের মতো সে মজা করছে.. ফলে বাঘ তাকে হত্যা করল।

শত শত বছর ধরে এই গল্পটা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে.. একটা শিক্ষণীয় গল্প হিসেবে আমরা ছোট বাচ্চাদেরকে গল্পটা শোনাই.. যাতে তারা মিথ্যা বলার ভয়ঙ্কর খারাপ দিকটা সম্পর্কে সচেতন হয়.. এবং মিথ্যাবাদীর পরিণতি সম্পর্কে ধারণা পায়।

কিন্তু আল মাহমুদ ব্যতিক্রম.. তিনি এই গল্পটাকে প্রচলিত ধারণার বাইরে নিয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, আমাদের আশ্চর্য হতে হয়।
images 40.jpeg

তার কবিতায় মিথ্যাবাদী রাখাল বাঘ, বাঘ বলে চিৎকার করে.. কিন্তু মানুষ যখন ছুটে আসে লাঠিসোটা নিয়ে.. দেখে বাঘ নাই.. তারা তাকে গালমন্দ করে.. তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসে।

আল মাহমুদের কবিতায় রাখাল মিথ্যাবাদী নয়.. বরং সত্যিই এসেছিল বাঘ.. রাখালের অস্বাভাবিক ইন্দ্রিয় ছিল বাঘের আগাম উপস্থিতি টের পাওয়ার.. তাই সে বাঘ, বাঘ বলে চিৎকার করে.. কিন্তু কোন কারণে বাঘ চলে যেত.. আর সবাই তাকে মিথ্যাবাদী ভাবতো।

সেই কাতর অনুনয় এখনো আমার মনে লেগে আছে।
আজ ভাবি, ছেলেটার কি তবে আগাম মৃত্যুর গন্ধ টের
পাওয়ার কোনো অস্বাভাবিক ইন্দ্রিয় ছিলো ? যার দুর্গন্ধে শত তিরস্কার উপেক্ষা করে সে চিৎকার করে উঠতো বাঘ বাঘ বলে, ঠিক কবির মতো?

(মিথ্যাবাদী রাখাল: কবি আল মাহমুদ)

images 41.jpeg

তারপর যেদিন বাঘ আসলো.. সেদিন সবাই বুঝতে পারলো যে- বাঘ সত্যিই আসতো.. অর্থাৎ রাখাল বালক মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মিথ্যাবাদী নয়।

মাঝে মাঝে ভাবি, ছেলেটি কেন এমন ‘বাঘ বাঘ’ বলে চেঁচাতো? আমরা ভয়ে বিহ্বলতায় চারদিকে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতাম শুয়োরের বাচ্চা। সে বোকার মতো হাসতো। বিব্রত, অপদস্থ। তারপর আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, মিথ্যাবাদীর ডাকে আমরা আর সাড়া দেব না। আমরা কেউ তার শেষ ডাকে সাড়া দেইনি যেদিন সত্যি এসেছিলো বাঘ। মৃত্যুর নখে ছিন্নভিন্ন হলো সেই ডাক।
(মিথ্যাবাদী রাখাল: কবি আল মাহমুদ)

আমাদের দেশে অনেক সময় এমন হয়.. অনেক ব্যাপারে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করি.. কিন্তু যখন সেটা ঘটে না.. সবাই তখন ভাবে কন্সপিরেসি থিওরি প্রচার করছি রাখালের মত.. আমাদেরকে মিথ্যাবাদী ভাবে.. তারপর যখন সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে.. তখন অনেক দেরি হয়ে যায়..

ঠিক যেমন করোনার এই ক্রান্তিকালে বিদেশে যখন হাহাকার শুরু হয়ে গেছে.. তখনো এদেশের অনেক মানুষ ভেবেছে- কই আমার দেশে তো কারো করোনা হয়নি.. মিডিয়াতে মৃত্যুর সংবাদগুলো শুনতো আর অবিশ্বাসের চোখে তাকাতো.. ভাবতো, আমাদের দেশে করোনা আসবে না।

কেউ কেউ অবশ্য সতর্ক করতো.. তাদের অবস্থা হত সেই মিথ্যাবাদী রাখালের মত। তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাংলাদেশে করোনা চলে আসলো.. ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে.. করোনা প্রতিরোধের যে ব্যবস্থাগুলো দরকার ছিল, সেগুলো নেয়ার সময় আমরা পার করে ফেলেছি।

এখন মনে হয়- সেই সময়টা যদি আবার ফিরে পেতাম.. তাহলে করোনা মোকাবেলার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতাম.. কিন্তু সময় একবার গেলে, সুযোগ একবার গেলে.. আর ফিরে আসে না।

কবির ভাষায় বললে:

আহ, আবার যদি ফিরে আসত
সেই মিথ্যাবাদী ছেলেটা
জনমত ও তিরস্কারের পাশে দাঁড়িয়ে
প্রান্তরের চারণের মতো বলে উঠতো,
‘মৃত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী-
হুঁশিয়ার’।

(মিথ্যাবাদী রাখাল: কবি আল মাহমুদ)
images 43.jpeg



0
0
0.000
0 comments