রুদ্র-তসলিমা উপাখ্যান এবং একজন জীবনদগ্ধ কবির পরিণতি..

avatar

বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়দগ্ধ কবি সম্ভবত রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

এদেশে অনেক প্রতিভাবান কবি এসেছেন.. অনেক অসাধারণ কাব্য রচনা করেছেন.. তাদের কেউ দীর্ঘ জীবন পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত.. কেউ স্বল্প জীবন পেয়েছে সুকান্তের মত.. আবার কেউ কেউ দীর্ঘজীবন পেলেও অসুস্থতার সঙ্গে একটা বড় সময় পার করতে হয়েছে নজরুলের মত..

কিন্তু রুদ্র-মুহাম্মদ-শহীদুল্লাহ একটু ব্যতিক্রম.. তার মত জীবনদগ্ধ কবি আর দ্বিতীয়টি আমি অন্তত খুঁজে পাইনি বাংলা সাহিত্যে..


তার আবির্ভাবের সময় মূলত সত্তর দশক.. সময়টাই ছিল একটু অন্যরকম.. মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম.. সেই স্বপ্নের সাথে দারিদ্রতা, ক্ষুধা এবং একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপর্যস্ত.. সেই সময়ের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে এইসব অনুষঙ্গ..

images (7).jpeg

অবশ্য অনেকেই তখন সরকারের ভয়.. কিংবা একটু আরাম আয়েশের আশায়.. এসব প্রসঙ্গ নিয়ে লিখত না.. রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর ব্যতিক্রম.. তিনি এসবের পরোয়া করতেন না.. তিনি সকল ভয় এবং চোখ রাঙ্গানি কাটিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠেছিলেন:

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি
আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত?
সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে..

৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত.. যতগুলো বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে.. সবগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ছিল রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর..

তিনি রাজনৈতিক দস্যুতা এবং ফ্যাসিবাদের চরম বিরোধী ছিলেন.. বুর্জোয়া অর্থনীতির একজন তীব্র সমালোচক ছিলেন.. এবং কমিউনিজম একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন.. তার কবিতায় আমরা বারবার এ ব্যাপারে ইঙ্গিত পাই:

কথা ছিলো, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন,
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।
অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু
অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।
জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,
আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন “

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মাত্র ৩৫ বছরের জীবন পেয়েছিলেন.. তিনি সারাজীবন বিভিন্ন কারণে আলোচিত এবং সমালোচিত ছিলেন.. এত অল্প বয়সে এতটা আলোচিত-সমালোচিত কবি বাংলা সাহিত্যে আর আসে নি.. হয়তো কখনো আসবে না..

তাকে নিয়ে আলোচনার অন্যতম উপকরণ ছিল তসলিমা নাসরিন.. নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে তিনি ভালোবেসেছিলেন এবং পরিবারকে না জানিয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলেন.. সেটা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে তার একটা মনোমালিন্য হয়।

এ ব্যাপারে তিনি তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে একটা দীর্ঘ চিঠিতে জেনারেশন গ্যাপ এর কথা উল্লেখ করে লিখেন:

আব্বা,
পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়,স্পষ্টতই তা দুটো বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি,আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন। এ তো চরম সত্য যে, একটি জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার আব্বার অমিল ছিলো, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত করতে পারি; পারি কিছুটা মসৃণ করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না। তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।

images (5).jpeg
বিয়ের পর রুদ্র

তসলিমা নাসরিন এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রেম যেন বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত রোমান্টিক উপাখ্যান.. তসলিমা নাসরিনকে উদ্দেশ্য করে রুদ্র‌ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বেশ কিছু কবিতা এবং গান লিখেছিলেন.. তার মধ্যে অন্যতম বর্তমান সময়েও সমান জনপ্রিয় গানটি:

ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটারে
আমার ভিতর বাহিরে
অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..

পরবর্তীতে অবশ্য তসলিমার সাথে তার সংসার টিকে না.. যদিও তসলিমা নাসরিন প্রথম থেকেই নারীবাদী লেখা লিখতে গিয়ে.. পুরুষ বিরোধী মানসিকতা দেখিয়ে এসেছে.. রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার সঙ্গে সংসার ভেঙে যাওয়ার পর.. তা যেন তার পুরুষ বিদ্বেষে রূপ পায়।

images (6).jpeg
রুদ্র ও তসলিমা

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অনেকটা নিজ হাতেই তসলিমাকে তৈরি করেছিলেন.. তিনি তসলিমার কেবল একজন স্বামী ছিলেন না.. ছিলেন প্রেমিক, বন্ধু এবং ওস্তাদ.. তাই তসলিমার লেখায় এ পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকটতা.. এবং সাহিত্য গভীরতার ঘাটতি তাকে এক ধরনের পীড়া দিত..

যদিও তখন তসলিমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল না.. তারপরও তিনি ওস্তাদস্বরূপ তসলিমাকে তার এই ঘাটতি ধরিয়ে দেয়া নিজের দায়িত্ব মনে করতেন.. সম্ভবত এ কারণেই এ সময় ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকায় রুদ্র একটি চিঠি লেখেন-

আর্ত আবেদন
আশির দশকের তরুণ লিখিয়েদের মধ্যে তসলিমা নাসরিন ইতিমধ্যে তরুণ কবি হিসেবে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। অগভীর ছুঁইয়ে যাওয়া হলেও তার ভাষা মেদহীন এবং বেশ জোরালো। মোটেই মেয়েলি গন্ধ নেই।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কলাম-বন্দী রচনাগুলোর ভেতর পুরুষ-বিকারগ্রস্ততা লক্ষ্য করছি। লেখাগুলো ঝগড়াটে মেজাজের।
অগ্রজ লেখক হিসেবে আমার, তার সম্ভাবনার প্রতি একধরনের দুর্বলতা রয়েছে। আমরা সবাই জানি তার দাম্পত্য জীবন সংঘাতময়। তার জন্য প্রথমত দায়ী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে আমি মোটামুটি সকল পুরুষদের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রচন্ড ধিক্কার জানাচ্ছি।
আশা করছি, এরপর আপনার ক্ষুরধার লেখনি থেকে পুরুষেরা রেহাই পাবে। আপনি বরং সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে সিরিয়াস হন।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
ঢাকা


মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এই অসীম প্রতিভাবান কবি বিদায় নেয়.. বাংলা সাহিত্য হারায় একজন সত্তিকারের জীবনবোধ সম্পন্ন কবিকে। ‌

20200720_001737.jpg

আমার পরিচিত:

আমি কাব্য.. কবিতা এবং সাহিত্য ভালোবাসি.. নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি.. হয়, আবার হয় না..



0
0
0.000
0 comments