ধুলো মাখা ডাইরি!

avatar
(Edited)

এখন প্রায় রাত তিনটা বাজে। ঘড়ির টিকটিক শব্দ টা অন্ধকার ঘরের, নিস্তব্ধতা ভেদ করে আমাকে তীব্রভাবে বিরক্ত করছে। আমার ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা শুরু হয়েছে রাত একটা থেকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুই ঘন্টা ধরে ঘুমের কোন দর্শন পেলাম না। একটা থেকেই ঘড়ি টিক টক শব্দ আর ঘরের অন্ধকার এর গভীরতা মেপে চলছি। আমি জানি আমার এই ঘুমের দর্শন না পাওয়ার পেছনে কারণ টা কি? আমার পাশের টেবিলে পড়ে থাকা পুরনো ডাইরিটা।

আমার পাশের ঘরে পুরনো বন্ধ রুমের দরজা হঠাৎ খোলা পেলাম। সেখানে কাঠের তৈরি একটি আলমারি থেকে ধুলোমাখা একটি ডায়েরি আবিষ্কার করেছি। ঘরটা সচরাচর বন্ধই থাকে তবে আজ কোন বিশেষ কারণে হয়তো ঘরের মালিক সেটাকে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। আগে ওই ঘরটা তে যারা ভাড়া থাকতো হয়ত তাদের মধ্য থেকে কোন একজনের হবে ডাইরিটা । আমার ঘুম না আসার পিছনে কারণ ওই অপরিচিত ডাইরিটার ভেতরকার লেখা গুলোকে নিয়ে। দুপুর থেকেই নিজের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর চিন্তা তৈরি হচ্ছে । কারণ অচেনা অজানা কোন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত লেখাগুলো তার অনুমতি ছাড়াই পড়াটা আসলে ঠিক হবে কিনা আমার ? সেটা নিয়েই ভাবছি।

কিন্তু এখন যখন নিজের রাতের ঘুমটাও গত হয়েছে। আর কৌতূহল এই মনটাকে কোনভাবেই বেঁধে রাখতে পারছিনা। তাই ডাইরিটা ফেলে রাখা উচিত হবে না আর। নিজের অন্ধকার ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে ডায়রিটা নিজের হাতে তুলে নিলাম। ডাইরির পাতাগুলো উল্টাতে আরম্ভ করি। ডাইরির প্রথমে কয়েকটা খালি পাতা উল্টিয়ে অবশেষে লেখার সন্ধান পেলাম। শুভ কাজে দেরি না করে ডায়রির লেখাগুলো পড়তে শুরু করি--

"""আমার প্রতিদিন শুরু হয়, কিরে কি করছিস আজকাল , কোন চাকরিতে যোগাড় হলো? আমার প্রতিবেশীদের আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তা। প্রতি দিনের শুরুটা তাদের এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয়। দিনের শুরুতেই তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় , ঠিক আমার কাঁধে বর্তমানে কত বড় দায়িত্ব রয়েছে। তারপরও এত বড় একটা দায়িত্বের গভীরতা মাপতে মাপতে সকালে লোকাল বাসে চড়ে শতাধিক মানুষের সাথে লড়াই করে পৌঁছেতে হয় নিজের টিউশনিতে । পড়াশোনা শেষ করে কথা ছিল বছর খানেকের মধ্যেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাব। কিন্তু এখন তিন নম্বর বছর কেটে যাচ্ছে।

যেখানে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ও মানুষের কাছে নিজের বলা কথার দাম রাখতে পারছে না । সেখানে আমি 15 থেকে 20 হাজার টাকার বিনিময় এনাদের কথার খেলাপ করা কোন বড় ব্যাপার বলে মনে করি না। সকালে আর দুপুরের খাওয়াটা একেবারে তিনটার দিকে রাস্তার পাশের কোন রেস্তোরা থেকে সেরে ফেলি। তারপর নানা দিকে চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়ানো আর তারপর সন্ধ্যা বেলাতে বাড়ি ফেরার পথে আবারো আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিবেশীদের আক্ষেপ আর উদ্যোগ প্রকাশ দিনের সমাপ্তি ঘটে প্রতিনিয়ত।

তারপর যখন রাতে একসাথে বসে খাওয়ার সময় বাবার ক্লান্ত অসহায় চেহারাটা দেখি। মুখে না বলতে পারা হাজারো কথাগুলো নিঃশব্দে আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করে দিয়ে দেয়। কিন্তু বাবা ঠিক ভালোভাবেই জানে বাজারে চাকরি পাওয়াটা কতটা কঠিন তাই হয়তো মুখ ফুটে আমাকে কিছু বলতে পারেনা। নিজের জীবনের 25 বছর পার করে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি। মেয়েরা লড়াই করতে করতে একটা সময় সময়ের সাথে নিজেদের হাল ছেড়ে দেয় এবং বিশ্বাস করে যা হচ্ছে নিজের ভালোর জন্যই । কিন্তু ছেলেদের তো এটা ভেবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না , তাই বেরিয়ে পড়তে হয় কোন এক অচেনা লড়াইয়ের জন্য। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই নিজের ছেলের উপর ভরসা রাখে। ছেলেরা নাকি বংশের প্রদীপ । কিন্তু প্রদীপ্ত যে নিজের সবটুকু দিয়ে জলে, অন্ধকারকে আলোকিত করে । সে খবরটা কি কেউ রাখে?

আমরা ছেলেরা স্বাধীনতার মিষ্টি স্বাদ পায় ঠিকই কিন্তু বাস্তবতার তিক্ত মোড়কে সেটা মুনা থাকে আমাদের সমাজটা কিছুটা এরকম না কাউকে নিজের ইচ্ছামত হাসিখুশি বাঁচতে দেয় না ওকে প্রাণ খুলে কাঁদতে নয়।"""

আর পড়তে পারছি না । মনটাই খারাপ হয়ে গেল । আসলে দুঃখ টা বেশ ছোঁয়াচে । ডায়েরিটা বন্ধ করে দিলাম। মনটাকে অনেক সামলানোর চেষ্টা করলেও কৌতূহলবশত 5 মিনিটের বেশি ডায়েরি টাকে বন্ধ রাখতে পারেনি তাই ডাইরিটা কে আবারো নিজের হাতে নিয়ে কয়েকটা পেজ উল্টিয়ে পিছন থেকে পড়া শুরু করলাম।

এইতো কিছুদিন আগে একটা শার্ট আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু কেনার মত সামর্থ্য বা পরিস্থিতি কোন কিছুই আমার ছিলোনা। নিজের টিউশনি টাকা থেকে যখন একটি একটু সঞ্চয় করে সেই স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করার চিন্তা করি তখন নিজের মনটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। উচ্চবিত্তরা হয়তো যা চায় তা তৎক্ষণাৎ পেয়ে যায় কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে দীর্ঘ একটা সময় থাকে যে সময়টাতে আমরা কল্পনার রাজ্যে ডুবে থাকি এবং স্বপ্ন পূরণের আনন্দ অনুভব করি।

প্রতিদিন রাত্রে বেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজের মুখে মুচকি একটা হাসি থাকে। কারণ সবসময় এটাই ভাবি চাকরিটা পেয়ে গেলে কি কি করব? নিজের ইচ্ছা গুলো প্রতিনিয়ত দরজায় কড়া নাড়ছে। আমি বিশ্বাস করিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি ধোঁয়ার মধ্যে যে জীবনের আসল সুখ লুকিয়ে থাকে এটা ঠিক নয়। নিজের পছন্দের মানুষগুলোর সাথে একসাথে ছোট সাদামাটা সাধারণ জীবন কাটানো সবথেকে বেশি সুখী। আমাদের কোন বিলাসবহুল বাড়ি না থাকলেও নিজের জীবনটা শান্তিপূর্ণ হলেই আমার চলবে। প্রচুর টাকার প্রয়োজন নেই কিন্তু সুখে থাকার জন্য যতটুকু অর্থ দরকার ততটা আমার প্রয়োজন।

মাঝেমধ্যে মনে হয় তবুও হয়তো আমি অনেকটা বেশি আশা করি কিন্তু প্রত্যেকটা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ বাস্তবের সাথে লড়াই করে চলে দিন সে সেটাই আশা করে মুখে হাসি নিয়ে বিছানায় ঘুমাতে যাব। আর আমাদের এই ছোট আশা গুলোই আমাদের একমাত্র বিশ্বাস। আর এই আশা নামক বিশ্বাসটা কে নিয়ে আমরা সব সময় খুশি থাকি। আমিও তাদের মধ্যে একজন। আমি বিশ্বাস করি বাবার ক্লান্ত মুখটাতে একদিন হাসি ফুটবে এবং আমিও নতুন করে জীবনটাকে উপভোগ করার সময় পেয়ে যাব। এটুকুই তো চাহিদা ।

আমি জানি এই পথচলতি মাইলফলকগুলো একদিন আমাকে ঠিক, আশা নামক গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাবে ।সে অপেক্ষাতেই না হয় অপেক্ষারত রইলাম এই আমি নামের এই নিন্মবিত্ত পরিবারের এক যাত্রী......................। "

লেখাগুলো শেষ করেই বুঝতে পারছিলাম কথাগুলো কানে বার বার বার ছিল ঘড়ির কাটায় খেয়াল করলাম পাঁচটা বেজে গেছে টেবিলের উপর ডাইরিটা রেখে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আশানুরূপ মানুষটার দেখা পেলাম,,,,,, ঘরের মালিক।

তারপর আমাকে দেখেই তিনি বললেন _______

-- কি ব্যাপার , আজ এত সকাল সকাল ? আমার মতো সকালে হাঁটতে বেড়োনোর কোনো প্ল্যান আছে নাকি আজ ?

-- না তেমন কিছু না , তাড়াতাড়ি ঘুমটা ভেঙ্গে গেল , তাই উঠে পড়লাম । আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল । আপনার এই পাশের ঘরটিতে কারা ভাড়া থাকতেন ? আর তারা কবেই বা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন?

-- হঠাৎ তাদের ব্যাপারে এ প্রশ্ন কেন ?

-- না তেমন কিছু না , তবে বললে খুব ভালো হতো ।

ঐ ঘরটিতে একটি পরিবার ভাঁড়া থাকতো প্রায় ১০ বছর যাবৎ। ৩ জনের পরিবার ছিল তাদের , বাবা, মা আর ছেলে । ছেলেটার বাবা কলকারখানা তে কাজ করতো ......। অবস্থা ততটাও স্বচ্ছল ছিল না । খুব কষ্টে সে তার ছেলের পড়ালেখাটা শেষ করিয়েছিল। তারপরই তার বাবার শরীরটা খারাপ হয়ে যায় , আর তাদের জীবন কাটানো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে । ছেলেকে চাকরির উদ্দেশ্যে মড়িয়া হয়ে উঠতে হয় । তবে চাকরির ঐ বাজারে ছেলেটার কোনো চাকরি কপালে জুটছিল না । এইভাবেই চরম দুর্দশায় দিন কাটছিল তাদের ......।

-- আচ্ছা , আপনি আমাকে বলুন ওনারা গেলেন কবে এখান থেকে ,? আর কেনই বা চলে গেলেন ?

--আজ থেকে ২ বছর আগে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর , ওনার ছেলের বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়ে যায়। আর তারপর , কাজের সূত্রে ১ বছর আগেই সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দেন । আমার মনে আছে ছেলেটা যেদিন চাকরি পেয়েছিলো , সেদিন খুশি তে ওর বাবা , মায়ের চোখে জল চলে এসেছিল.....।

তার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম এবং খুশিতে আত্মহারা। তারপর নিজেকে সামনে নিয়ে তাকে বললাম, ঠিক আছে আপনাকে ধন্যবাদ শুধু এই টুকুই জানার ছিল।

ঘরের মালিক এর কথা শেষ হলে তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চোখের সামনে থাকা খোলা ডাইরিটা দেখে এখন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। কেমন যেন এক ধরনের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে, বাইরে থেকে একরাশ হাওয়া আমার জানালা দিয়ে প্রবেশ করল। সেই ঠান্ডা হাওয়া ডাইরির পাতাগুলো কে এলোমেলো করে দিয়ে গেল শরীরে আমার গায়ের উপর সেই বাতাসা আজকের পরল।ডায়েরির এলোমেলো ঐ পৃষ্ঠাগুলোর ভেতর একটা অংশের লেখা বিশেষ ভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ---- " হাল ছেড়ো না বন্ধু ........"

IMG_20211113_121102.jpg



0
0
0.000
1 comments
avatar

অসাধারণ লিখেছেন। শেষ পরিনতিটা নিয়ে একটু ভয়ে ছিলাম। তবে হেপি ইন্ডিং 😍

0
0
0.000