সেলিমপুর আমার সেলিমপুর ❤️

avatar

একটি গ্রাম। যার কথা বলছি। একটি গ্রাম, যেন একটি পরিবার। একই ভাষাভাষীর বসতির, মুসলিম, হিন্দু, নাপিত, তাঁতি, কামার, কুমার, ধোপা। সব পেশাজীবীদের অভায়রম্ন যেন। যেই গ্রামটির কথা বলছি তা আমার পূর্বপুরুষের এবং পরবর্তী পুরুষের। যেখানে ষড়ঋতুর সবটাই বিদ্যমান। ভরা যৌবনে নদীর গর্জন শোনা যায়। চাঁদের আলো পানিতে পরে রাতের বেলায় সোনালি রূপ ধারণ করে। যে গ্রামটির কথা বলছি সেটি বন বাজারি দিয়ে ঢাকা। পাখপাখালি, শেয়াল, শকুনের দলের ডাক যেমন তেমনি চিল, বাজ পাখি, ঘুঘু, মাছরাঙা, শালিক, ডাহুক কিংবা বকের ডাক শোনা যায়।

IMG-20210906-WA0000.jpg

অগ্রহায়ণে ধান ক্ষেত হতে পাকা ধানের সে যে কি ঘ্রান। আমি সেই গ্রামটির কথাই বলছি, যেটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হত। শ্রীরামপুর, সিলুমপুর, সিলামপুর, হিলুমপুর নামে ডাকা হতো। সর্বশেষ নামকরণ করা হলো "সেলিমপুর"। চিন্তা চেতনায় শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া গ্রামটি, কুশিক্ষার স্থলে সুশিক্ষায় স্থান করে নেয়। একই ভাবে কাগজ-পত্রে স্থান পেলো সেলিমপুর। বরিশাল জেলার মুলাদি থানাধীন এ গ্রাম। সুলতান সুলেমান খানের পুত্র সেলিম খানও ছিলেন সুলতান। সুলতান হওয়ার পথ সুগম করতে ভাই এমনকি ভাইপোদের তিনি হত্যা করেছিলেন। শাসনকাল ছিলো অন্যায় অবিচারে ভরা। যেহেতু তিনি সুলতান সুলেমান খানের পুত্র সেলিম খান, সেকারণেই আমার গ্রামটির নাম রাখা হলো সেলিমপুর।

অত্র এলাকার আধ্যাত্মিক পুরুষ ফকির কামিজউদ্দিন আহম্মেদ শাহ এর বড় পুত্র মোহাম্মদ শাহ জাহান কবির। তিনি অত্র এলাকার আলোক মশাল হয়ে জন্মেছিলেন। বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করার পর নিজেকে আদর্শবান সমাজ সচেতন পুরুষ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোস করেননি। গ্রামের নতুন নামকরণ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হতে পারেন এমন আশংকা তার ছিলই। তার পরও তিনি দমে যাননি। অফিসিয়াল কাগজপত্রে লিখতে লিখতে গ্রামটি আজ প্রতিষ্ঠিত সেলিমপুর।

সেলিমপুরের পশ্চিম পাশ দিয়ে অতীতের মতোই বয়ে যাচ্ছে আড়িয়াল খাঁ। আর পূর্ব দক্ষিনে বয়ে যাচ্ছে জয়ন্তী। নদী দুটি ভরা যৌবনে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন করে দেয়। ধান, পাট, আখের ক্ষেত নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একুল ভেঙে ওকূল গড়ে নদি। ভাঙ্গা গড়ার খেলায় সেলিমপুর অনেকটাই ছোটাকৃতিতে পরিণত হয়েছে। একটি হাটের স্থলে তিনটি হয়েছে। সেই সেলিমপুর এখন কেমন আছে? অতীতে কেমন ছিলো?

অতীতে এখানে জাতিতে জাতিতে কোনো ভেদাভেদ ছিলোনা। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে হিন্দুরা দাওয়াত পেতেন, একইভাবে হিন্দুরে উৎসবগুলোতেও মুসলমানরা দাওয়াত পেতেন। সেকি এক রিদ্দতা ছিল। পৃথক ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিলোনা। এখন আন্তরিকতার লোপ ঘটেছে। হিন্দু জাতির একটা বড় অংশ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে তা কেউ জানে না। মালো পাড়ার নিমাই, তার ছেলে জীবন কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, রাম কৃষ্ণ , গঙ্গাচরণ পন্ডিতের বাড়ির নদীর, ঝন্টু, দিলীপ, ভেদু কবিরাজ, পালপাড়ার নীলু, সুনীল স্যার, গান্ধী, দিলীপ, পুঁইল, গোলাপি, সন্ধ্যারানি, জোস্নারানি, বিভা সহ অনেকেই শান্তিময় এই গ্রামটি ছেড়েছে।

সাড়ে তিনশো তাঁত চলতো এই গ্রামে। সুকর মাতবর, কুদ্দুস মাতবর, মোশাররফ মাতবর, নুরুল ইসলাম বেপারী, রশিদ বেপারী সহ অনেকেই হস্তশিল্প চালিয়ে কাপড় বুনন করতেন। এখন আর তাঁত শিল্প নেই। এই গ্রামের তাঁতীরা বাপ দাদার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশাকে গ্রহণ করেছেন। সেলিমপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ক্রীড়া ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডল। নাটক, যাত্রাপালা, জারি- সারি গান নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হতো। হা ডু ডু, ফুটবল, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট ছিলো এই গ্রামের প্রধান খেলা। নাটক নেই, যাত্রাপালা নেই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই, হারিয়ে গেছে। একই ভাবেও কি খেলাধুলাও হারিয়ে যাবে?



0
0
0.000
0 comments