সময়ের খাঁচার স্মৃতিধারা

avatar

জীবনে প্রতিটি কাজে ধৈর্য্য ও একাগ্রতা সাথে নিয়ে পথ চলতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয় - এ বিষয়টি সম্পর্কে যখন ভাবার সময় এসে যায় তখন সময়ের পালাবদলে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এ পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি ঠকে শিখে, অপূর্ণতায় আক্ষেপ খুঁজে পায় আর তার সাথে অনেকগুলো বিশ্বাসের জায়গা ঢিলে হয়ে যেতে থাকে। এসবই বাস্তব।

এ লেখাটি যখন লিখছি তা বিডিকমিউনিটির বাংলা পাঠকবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে যারা এমন অনেক কিছুু জীবনের সময়ের পরিক্রমায় হারিয়েছে। হাসিদুঃখ বেদনা নিয়েই জীবন, হতাশা রয়েছে, নানা টানাপোড়েন আর আক্ষেপ রয়েছে, গ্লানি আর মর্মের উপলব্ধির ধারা আছে। প্রায়শই জীবনের অনেক উপলব্ধিজাত অনুভূতি একই রকম দেখতে, তার মাঝে কিছু স্মৃতি অনেকদিন হাতড়ে বেড়ায় পাওয়া না পাওয়ার খেলায়।
Src

যখন চোখে পড়ে ক্ষমতার শেষ রয়েছে, মানুষ স্বভাবতই অনেক সম্পদ অর্জন করে আবার সময়ের সাথে তা হারিয়ে যায় - এসবই জীবনের একটি শাশ্বত রূপ তুলে ধরে। স্বল্পের দম্ভে আর অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করা আর যখন অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে এসে দাঁড়ায় তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা থাকে না, কারণ সে দিনের সূর্যও নেই তার তেজও নেই। অপরাহ্নের বিকেলের মতো তা নিভে নিভে জ্বলে যায়।

আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যাদের অর্থের প্রতাপে আর ক্ষমতার দাপটে পা মাটিতে পড়তো না, পাইক-বরকন্দাজ লেঠেল আর নকিবদের আনাগোনায় মুখর হয়ে থাকতো চারপাশ। অঢেল সম্পদের পাহাড়ের মধ্যে পড়ে আয়-ব্যায়ের ভারসাম্য বজায় রাখার স্থিতি ও প্রয়োজন বোধ করতো না। দশ টাকার জায়গায় বিশ টাকা খরচ করতো, কখনো অতিব্যয় আবার দানশীলতার বাহাদুরি দেখাতো। শেষকালটায় একটা অনিঃশেষ ভাটা এসে পড়তো।

ধনসম্পদের সাথে ক্ষমতার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে, দুটো যদিও সমানতালে চলে না তারপরেও একটি অন্যটির পরিপূরক। আবার একটি চলে গেলে অন্যটিও চলে যেতে চায় যেন তারা একটি আরেকটির ছায়া। সম্পদের লেবাসও সবসময় একরকম থাকে না কখনো, তা বাড়ে আর কমে, সেই ঔপনিবেশিক কাল থেকে যখন ছোটবড় জমিদার পরিবারগুলো গড়ে উঠেছিল আর তাদের অগাধ প্রতিপত্তি , সম্পত্তির বৈভব - সবকিছুই গড়ে উঠেছে আবার বিলীন হয়ে গিয়েছে।

আপনারা হয়তো বাংলাদেশের এমন অনেক দর্শনীয় স্থান ভ্রমন করেছেন, বিভিন্ন ঔপনিবেশিক কালের, কিংবা তারো আগের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, কাছারি বাড়ি, পুরনো পোড়ামাটির ফিকে হয়ে যাওয়া স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। এদের মধ্যে একটি সাধারণ ব্যাপার হলো কিছু মায়া যা বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই জেগে ওঠে, কত স্মৃতি কত আয়োজন আর হারিয়ে যাওয়া রংমহলের গল্প - কালের চোরা স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে!

কিছুদিন আগের নাটোরের একটি জমিদার বাড়ি ঘুরে এসেছিলাম। নাটোর জেলাটি আর যা হোক যারা বাংলা সাহিত্য, টুকটাক আধুনিক বাংলার কবিদের রচনা পড়েছে কিংবা জীবনানন্দ দাশের নাম জানে, তারা নিশ্চয়ই বনলতা সেনের সেই রোমান্টিকতায় কিছুক্ষণ আটকা পড়ে থাকে। তাই বারবার কেন জানি বিংশ শতকের দিকে চলে যাচ্ছিলাম।

চারদিকে বিলের অনাবিল সৌন্দর্য্য আর সকরুণ মায়ার জালে দুঃখগুলো মনের জালে আটকে রেখে চাপাকষ্টে দিন পার করছে বাড়িটি। বাড়ি না বলে যদি একটি দোতলা লম্বা দালান বলি তাহলে তার মান রক্ষা করা হবে। কারণ সত্যিই সেই জমিদারি জাঁকজমক নেই কিন্তু তার আকুতি আর আতিথেয়তা মোটেই বদলায় নি, তা ক্রমশ দূর থেকে ডেকে যায়, তার টান আমাকেও কাছে টেনে নিয়েছিল।
Src

জমিদারী সেই কবেই বিলীন হয়ে গিয়েছে কিন্তু তার একটা অদ্ভুত টান রয়ে গেছে। আগের দিনের মতো নিজের সদর কক্ষে জমিদার উপবিষ্ট নেই, তার বাহারি সুগন্ধিমাখা আলবোলা হুঁকা নেই, পাখা হাতে বাতাস করার লস্কার নেই, গয়না পরা গিন্নীরা অন্দরমহলে শোভা দেয় না। সময় সব শেষ করে দিয়েছে আর তার সাথে জীবনের সব লেনদেন। জমিদারমশাইয়ের সেই টাঙানো ছবিখানার দিকে তাকিয়ে আমার একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস উঠলো।

একসময় হয়তো ক্ষমতা ও অর্থ দুয়ের নিখুঁত সমন্বয় ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তা ক্ষয়ে গেছে। এভাবে কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। সময়ও নিজের গতিতে বয়ে চলেছে।

প্রথমে একটি অপূর্ণতার কথা বলেছিলাম, জীবনের তরে তা অমোচনীয় সত্য কথা। মানুষের জীবনে একদিন না একদিন উপলব্ধির দ্বার খুলে যায়, যখন মানুষ বুঝতে পারে অপূর্ণতার মধ্যে আক্ষেপ খুঁজে কোন লাভ নেই। যা চলে যাবে, তা তো যায়- ই। তবে যতটুকু সময় স্মৃতিপটে ভেসে বেড়াবে তার যথাযথ মূল্যায়ন আর অনুভূতির সম্মেলনই শ্রেষ্ঠ পাওয়া।

গ্রীষ্মের তাপের আগমনী বার্তার মাঝেও যখন হালকা হল্লা দিয়ে বৃষ্টিধারা নামে, বটবৃক্ষের ছায়ায় নবপল্লব জেগে ওঠে, নতুন করে নবযৌবনপ্রাপ্তি আর পূর্ণতায় উঠে আসে পুরনো স্মৃতি আর বয়ে যাওয়া সময়ের পটে জীবন।

যা শুধু বয়ে চলে...



0
0
0.000
0 comments